প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্প্রতি টেলিফোনে কথা বলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। জানা গেছে, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ অঞ্চলের কূটনৈতিক মহলও নড়েচড়ে বসেছে। কারণ এ মুহূর্তে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব চলছে। পাকিস্তান যেহেতু চীনের মদদপুষ্ট, সে কারণে হাসিনাকে ইমরানের টেলিফোন একটি বড় ঘটনাই। বাংলাদেশ যদি ইমরানের আহ্বানে সাড়া দেয় তবে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে কিছুটা পরিষ্কার ধারণাও জন্ম নিতে পারে, যা এ অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
কিন্তু সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, টেলিফোন করে সম্পর্কের উন্নয়ন হবে না। যেসব কারণে তাদের সঙ্গে আমাদের তিক্ত সম্পর্ক রয়েছে, সেই বিষয়গুলোর মীমাংসা আগে হতে হবে।
গত ২২ জুলাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে আসা পাকিস্তানের সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে চায়।
কিন্তু সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটা সম্ভব নয়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির ওপর পাকিস্তান যে গণহত্যা চালিয়েছে, তার জন্য এখনও তারা প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়নি। উপরন্তু গণহত্যায় প্রত্যক্ষ অংশ নেওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় পাকিস্তান প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করেছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান কূটনৈতিক সম্পর্ক যে পর্যায়ে রয়েছে এর বাইরে নতুন করে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবুল মোমেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘তিনি কোভিড-১৯, বন্যা নিয়ে কথা বলেছেন। এটা ছিলো সিম্পল কার্টিসি কল। সম্পর্ক যদি তারা ভালো করতে পারে, সেটা ভালো। একটি জিনিস তো তারা এখনো করেনি, তারা গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়নি। তা না হলে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। ক্ষমা না চাইলে সম্পর্ক গভীর হবে কীভাবে? আমরা তো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই। ’
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের ওপর গণহত্যা চালায়। তখন তাদের হাতে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন। এই গণহত্যার জন্য এখনো পাকিস্তান ক্ষমা চায়নি। শুধু তাই নয়, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পাকিস্তান প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে। কূটনৈতিক রীতি ভঙ্গ করে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা চালিয়েছে। ২০১৩ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের সময় পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছে। বিচার ও ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রতিবাদ জানিয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে উত্তপ্ত আলোচনা ও নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়। ওই সময় বিষয়টি জাতিসংঘে তোলার কথাও বলে পাকিস্তান। এমন কি তখন ইমরান খানের পার্টি এবং ইমরান খান (তখন ক্ষমতার বাইরে ছিলেন) নিজে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি উস্কানিমূলক বক্তব্যও দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ফাঁসির বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠিও দিয়েছিলেন। এসব কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবনতির সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়।
এদিকে সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্কেও পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২০১৬ সালে পাকিস্তানে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশসহ চার সদস্য রাষ্ট্র ওই সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়ালে সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চলছে। সব মিলিয়ে আঞ্চলিক অবস্থানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দেশটি। এই সার্বিক পরিস্থিতিতে ইমরানের ফোন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন প্রয়াস বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা জানান, বাংলাদেশের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের হাতে এমন কিছু নেই যার জন্য ওই দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থ প্রভাবিত হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, যার জন্য নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পাকিস্তান এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাব বিস্তারকারী রাষ্ট্র নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা ছাড়াও বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার অপতৎপরতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও জঙ্গি গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বিদ্যমান সম্পর্ক গভীর হওয়া তো দূরের কথা উন্নয়নের সম্ভাবনাও ক্ষীণ বলে সরকার ও আওয়ামী লীগের ওই নীতিনির্ধারকরা মনে করেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘ফোন তারাই দিয়েছে, আমরা দেইনি। কূটনৈতিক সম্পর্কের জায়গা থেকে ফোন ধরা হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বলেছেন এটা স্বাভাবিক সৌজন্যতা, কূটনৈতিক শিষ্টাচার। আমরা তো কারো সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে চাই না। ’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সার্কভুক্ত দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো বিষয় নিয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হতেই পারে। কিন্তু কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে সেগুলোর মীমাংসা করতে হবে। সেগুলো মীমাংসা না হলে সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব না। বাংলাদেশ তো যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। টেবিলের আলোচনায় তো স্বাধীন হয়নি। ’