মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত রেখে নতুন দলের গঠনতন্ত্রের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে জামায়াতে ইসলামী। আদর্শ ও সাংগঠনিক কাঠামোর দিক থেকে নতুন এ দলটি হবে দেশের বিদ্যমান ‘জেনারালাইজড’ পার্টিগুলোর মতো। সাংগঠনিক বিন্যাসে থাকবে না ক্যাডার পদ্ধতি। তবে বর্তমান জামায়াতের বিদ্যমান নেতৃত্বের একটি অংশকে নতুন দলের সামনে দেখা যাবে। পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত অন্তত চার জন উচ্চপর্যায়ের নেতার সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
রবিবার (২৬ জুলাই) জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নতুন দল ও দলের আত্মপ্রকাশ নিয়ে চিন্তা দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। একদিকে, বিশ্ব ব্যবস্থায় আশু পরিবর্তন এবং একই সঙ্গে দেশীয় রাজনীতিতেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন দলটির সিনিয়র নেতারা। এক্ষেত্রে দলের একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার ভূমিকা ও তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে নতুন দলকে সামনে আনার সমূহ প্রয়োজন বলে মনে করছেন জামায়াতের নীতি নির্ধারকরা। এ নিয়ে দলটির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে দুই ধরনের চিন্তা বিদ্যমান থাকলেও দলের মজলিসে শূরার অনুমোদন পাওয়ায় প্রক্রিয়াটিকে যথাসম্ভব সম্পন্ন করার মতো জোরালো হয়ে উঠছে সংগঠনের অভ্যন্তরে।
জামায়াতের নীতিনির্ধারণীয় পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত বড় হচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও একাত্তর ইস্যুটিকে সেটেল করার মানসিকতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখেই গত ২০১৯ সালের ১৬ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি দলের দায়িত্বশীলদের চিঠি দিয়ে নতুন দল গঠনের জন্য ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের কথা জানায় হাইকমান্ড। ওই চিঠি দেওয়ার আগে শূরার বিশেষ বৈঠকে নতুন দল গঠনের অনুমোদন নেওয়া হয়।’
নতুন দল হবে জেনারালাইজড, থাকছে না ক্যাডার-পদ্ধতি
জামায়াতের নতুন দলের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য কয়েকটি নাম প্রস্তাবিত খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোনোটিই এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত করা হয়নি। গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষ, চলছে শেষ মুহূর্তের ঘষামাজা। নতুন দলের ঘোষণাপত্রে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন ও গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছে।
প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র জানায়, মূল ঘোষণাপত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রসঙ্গটি উল্লেখ থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনও ধর্মের আদর্শ বাস্তবায়নের কথা থাকবে না।’
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বাধীন নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একজন সদস্য বলেন, ‘নতুন দল সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে ঘোষণা পত্রে। তবে কর্মসূচিতে ধর্মভিত্তিক ইস্যু থাকবে।’ সাংগঠনিক কাঠামোর কাজটি শেষ হলেও কোনও নেতাই এই নিয়ে বিস্তারিত জানাতে আগ্রহী হননি।
বিশেষ কমিটির আরেক সদস্য জানান, সাংগঠনিক কাঠামো বর্তমান বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মতো হবে। জামায়াতের নেতাকর্মীদের বর্তমান রুকন-পদ্ধতি থাকবে না। থাকবে না, কর্মী তৈরির জন্য সুনির্দিষ্ট কোনও সিলেবাস।
‘‘মূল দল জামায়াতকে অক্ষুণ্ণ রেখে নতুন দলের মূল তৎপরতা থাকবে রাজনৈতিক, আর যে কারণেই জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ছয় নম্বর ধারার চার নম্বর দফা ‘গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও চরিত্রবান লোকের নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা’’ স্থগিত করা হয়েছে। বিষয়টি আরও আগে বলছিলেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার একজন সদস্য।
কবে আত্মপ্রকাশ করবে জামায়াতের নতুন দল?
জামায়াতের অন্যতম একজন নায়েবে আমির বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রমিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসছে। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও পরিবর্তনের আশু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে জামায়াত পুরো পরিস্থিতির ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ রাখছে।
জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা, স্বাস্থ্যখাতে অবারিত দুর্নীতি ও ভারত-চীন ইস্যুতে চাপের মুখে পড়েছে বর্তমান সরকার। ঠিক এই সময়ে বিএনপির মধ্যেও জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে দলটির অভ্যন্তরে যে আলোচনা উঠেছে, এ বিষয়টিও কনসার্নে রয়েছে নেতৃত্বের। যে কারণে নতুন দল গঠন ও আত্মপ্রকাশের প্রক্রিয়াটি নিয়ে আরও ভাবতে হচ্ছে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের।
দলটির প্রভাবশালী একজন নেতা বলেন, ‘২০ দলীয় জোট বিএনপি একা গঠন করেনি। ১৯৯৯ সালে সাংবাদিক আনোয়ার জাহিদ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যৌথ সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে এই জোট চার দলীয় জোট আকারে গঠিত হয়। সে কারণে জোটগত সম্পর্ক বিএনপির ঘোষণাতেই শেষ হবে না। অন্যান্য দলও জোটরক্ষা করতে চায় কিনা, সে বিষয়টিও এখানে উল্লেখযোগ্য।’
মজলিসে শূরার সদস্য, ফেনী জেলা জামায়াতের আমির একেএম শামসুদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নতুন দল গঠনের বিষয়টি নিয়ে আমাদের অগ্রগতি জানানো হয়নি। দলের দায়িত্বশীলরা এটা নিয়ে কাজ করছেন, কবে নাগাদ আসবে, এটা আমাদের বলা হয়নি। আমরা এখন সংগঠনের অভ্যন্তরীণ নিয়মতান্ত্রিক কাজ করছি।’
দলের প্রভাবশালী একজন নায়েবে আমির বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ছে। সরকারের অবস্থা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হচ্ছে। অনেক জায়গায় লুজিং। এটা দিনে দিনে গভীর হচ্ছে। একটা অন্তর্বর্তীকালীন পরিবর্তন হতে পারে।’
তবে জামায়াতের কোনও কোনও নেতার ভাষ্য, ইতোমধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন করে যোগাযোগ, মানবতাবিরোধী অপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সরকারের নানা পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে দল এবং তার পরিবারের কথা বলার প্রক্রিয়াটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একটি নতুনত্ব আসার সম্ভানাকে সামনে রেখেই নতুন দল আত্মপ্রকাশের রাজনীতি নির্ধারণ করা হবে।
জামায়াতের প্রভাবশালী একজন দায়িত্বশীল বলেন, ‘নতুন দলে মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও সমাজের সংস্কৃতি নির্ভর ধর্মীয় মূল্যবোধকে সামনে রেখেই কাজ করবে। আমরা দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিফলন দেখতে চাই। তবে সেক্যুলার না।’
নতুন দল যেকোনও সময়ে আত্মপ্রকাশের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে, এমনটি জানিয়ে এই নেতা বলেন, ‘পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর আত্মপ্রকাশ নির্ভর করছে। প্রথমত, সরকারের তরফ থেকে কোনও বাধা আসবে না, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার ধরন কতটা সাবলীল হবে, এ বিষয়গুলো তাৎপর্যপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘নতুন দলে দুই থেকে তিন হাজার দায়িত্বশীল নেতৃত্বে আসবে। তারা অফিস করবে। সরকার, বিভিন্ন সংস্থা যদি এই প্রক্রিয়া হ্যাং করে রাখে? তাহলে তো কোনও লাভ নেই। ফলে, আমরা আমাদের অনুকূল সময় পেলেই ঘোষণা দেবো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও নতুন দল গঠনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটি পর্যায় পর্যন্ত আমরা কাজটি এগিয়ে রেখেছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয় আমাদের। অগ্রগতি হয়েছে। কমিটি যতটুকু কাজ করার কথা, সেগুলো করা হয়েছে। আর কবে ঘোষণা হবে, সেটা সময় হলে আমরাই বলবো।’