করোনার কারণে প্রায় ছয় মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। বন্ধ রয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। তবে বন্ধ নেই টিউশন ফি আদায়। টিউশন ফি আদায়ের জন্য কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান হিসাব শাখা খোলা রেখেছে। কোথাও অনলাইনে এই ফি পরিশোধের জন্য অভিভাবকদের তাগাদা দিচ্ছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের চাপে এখন পুরো ছয় মাসের টিউশন ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে।
করোনাকালে অনেক অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন, কারো বেতন কমেছে। এই মুহূর্তে তাদের তিনবেলা খাবারের অর্থ আয়ই কষ্টসাধ্য। আবার এরই মধ্যে স্কুলের টিউশনি ফি পরিশোধের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে নানা শঙ্কায় রয়েছেন অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা। টিউশন ফি পরিশোধের বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবক উভয়ের জন্য একটি গাইডলাইন দিয়েছিল শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু এসব পরামর্শ বা গাইডলাইন আমলেই নিচ্ছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ।
অভিভাবকদের শঙ্কা, এখন টিউশন ফি আদায়ের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ তেমন কঠোর নয়। তবে প্রতিষ্ঠান খোলার পর কঠোর হবে। টিউশন ফি একসঙ্গে আদায় করবে। এই ফি আদায় না করলে স্কুলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। পরীক্ষায় অংশ নিতেও দেওয়া হবে না। শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপে রাখবে। এ কারণে অভিভাবকেরা এখনই এর সুরাহা চান।
শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শ বা গাইডলাইন কী ছিল
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ উভয়কে মানবিক আচরণের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, এই সময়ে স্কুল বন্ধ আছে, প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, সে কারণেও কিছু খরচ আবার কম। সেই খরচটুকু বাদ দিয়ে বাকি যে খরচ—শিক্ষকদের বেতন, অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেকে পুরো বেতন হয়তো এই সময়ে পাচ্ছেন না, বিশ্বব্যাপী চিত্রটা একই, বাংলাদেশ শুধু একমাত্র দেশ নয়। কাজেই উভয় পক্ষ থেকেই আসলে কিছু ছাড় দিতে হবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজেদের কিছুটা হলেও আগামী কয়েক মাস চলার মতো, কোনোভাবে চলার মতো সামর্থ্য আছে, তাদের অনুরোধ করব ফি কিস্তিতে হোক বা কিছুদিন বাদ দিয়ে পরে নেওয়া হোক, সেটি করতে পারলে ভালো। না হলেও দেখেন কতটা ছাড় দেওয়া যায়, সেটা চেষ্টা করবেন।
শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শ বা গাইডলাইন উপেক্ষিত
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, টিউশন ফি পরিশোধ করতে হবে। আর স্কুল কর্তৃপক্ষকে কিছুটা ছাড় দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই পরামর্শ বা গাইডলাইন মানছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক আব্দুল মজিদ সুজন বলেন, ‘আমরা টিউশন ফি দিতে চাই। কিছুটা হলেও কম। কিছুটা কমানো হোক। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ টিউশন ফি কমানো তো দূরের কথা, বরং করোনার সময়ে তিন মাসের টিউশন ফি পরিশোধ না করায় উলটো জরিমানাও করেছে।’
অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল হক দুলু বলছেন, ‘আমরা করোনাকালীন টিউশন ফি মওকুফের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলাম। সেই আবেদনে কোনো সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এক অভিভাবক জানিয়েছেন, তার সন্তান মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ছে। করোনার দুর্যোগে তিনি চাকরি হারিয়েছেন। লোকলজ্জায় তিনি বিষয়টি প্রকাশ করতে পারছেন না। জমানো টাকা দিয়ে এখন তার সংসার চলছে। অন্যদিকে টিউশন ফি পরিশোধের জন্য স্কুল থেকে এসএমএস পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু একসঙ্গে চার-পাঁচ মাসের বেতন দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া টিউশন ফিও কমানোর দাবি তার। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান চালু হলে স্কুল থেকে চাপ দেওয়া হবে। না দিলে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হবে না। এমন চাপ দেওয়া হবে। তিনি স্কুলের টিউশন ফি অন্তত ৫০ শতাংশ কমানোর দাবি জানান।
কী করছে মন্ত্রণালয়
অভিভাবকদের বক্তব্য, টিউশন ফি নিয়ে মন্ত্রণালয় নীরব। মন্ত্রণালয়ের নীরবতায় স্কুল কর্তৃপক্ষ পুরো টিউশন ফি আদায় করছে। দুই-তিন মাস ধরে অভিভাবকেরা টিউশন ফি কমানোর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হলেও তাতে কোনো সাড়া পাননি। শিক্ষামন্ত্রী যেন বক্তব্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন।
অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, টিউশন ফি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যই স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের জন্য গাইডলাইন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না স্কুলগুলো। তাই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে এবার নির্দেশনা জারি করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দরিদ্র অভিভাবকদের জন্য বিশেষ ছাড় দিতে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হতে পারে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘অভিভাবকদের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি কমানোর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন অনুসরণ করছে না এমন অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এ কারণে আমরা একটি নির্দেশনা জারি করব।’
তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্ধ চলছে। আপাতত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ থাকছে।