ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব করার পর প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ঢাকায় সিআইডি পুলিশ ১৫ জন নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেফতার করেছে।
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্রেফতারকৃতরা সামাজিক মাধ্যমে কখনও নারী বা কখনও পুরুষ সেজে আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষকে বন্ধু বানানোর পর উপহার দেয়ার লোভ দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এরা একটি আন্তর্জাতিক চক্র বলে পুলিশ ধারণা করছে।
পুলিশ জানিয়েছে, এ ধরণের প্রতারণার অভিযোগে এ পর্যন্ত দেড় মাসে ৪০জনের বেশি নাইজেরিয়ানকে ঢাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
ঢাকায় সর্বশেষ যে ১৫জন নাইজেরিয়ানকে ধরা হয়েছে, তাদের শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে হাজির করে এই চক্রের প্রতারণার নানা তথ্য তুলে ধরেছে সিআইডি পুলিশ।
গ্রেফতারকৃতদের সকলেই পুরুষ। কিন্তু তারা ফেসবুকে নারী সেজে পুরুষদের সাথে বন্ধুত্ব করতেন। তারা আমেরিকান সেনা বাহিনীর নারী কর্মকর্তা হিসাবে পরিচয় দিতেন। আবার নারীর সাথে বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে তারা পুরুষ পরিচয়েই তা করতেন।
বন্ধুত্ব কিছুটা আবেগের জায়গায় পৌঁছালে তারা লোভ দেখিয়ে প্রতারণা জাল ফেলতেন। তারা কখনও আফগানিস্তান, কখনও সিরিয়ায় আমেরিকান সেনাবাহিনীর সদস্য হিসাবে যুদ্ধে রয়েছেন-এমন সব পরিচয় দিয়ে বানানো বন্ধুদের বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন অভিনব নানান তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন সিআইডি পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রেজাইল হায়দার।
তিনি বলছেন, “ফেসবুক আইডি বা ফেক আইডি ব্যবহার করে তারা আমেরিকা বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বন্ধুত্ব করে। এই শুরুটা হয় একটা হার্মলেস মানে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব সম্পর্ক আরকি। ট্রাস্ট বিল্ডিংটা হয়, তারপর প্রলোভনের পর্যায়টা আসে। ডলার, স্টোন বা দামি কোন উপহার দেবে, তার ছবি দেখিয়ে প্রতারণায় ফেলে।”
বাংলাদেশে অনেক মানুষ এই চক্রের ফাঁদে পড়েছিলেন, এমনই একজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার পর কয়েক ধাপে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেয়ার পর তার সন্দেহ হয় যে, তিনি প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন।
সেই ফাঁদে পড়ার গল্প যেমনটা তিনি বলছিলেন, “ফেসবুক আইডিতে ফেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল ক্যাপ্টেন ন্যান্সি নামে। মানে আমেরিকান আর্মির কর্মকর্তা। বন্ধুত্ব হলে কিছুদিন চ্যাটিং হওয়ার পর সে বলতেছে আমাদের দেশে বেড়াতে আসবে। সে সিরিয়ায় মিশনে আছে।সেখানে মিশন শেষ করে বাংলাদেশে আসতেছে এবং একট গিফট পাঠাতে চায়।”
তিনি আরও বলেন, “এরপর শুরু হয় নানাভাবে টাকা চাওয়ার পালা।প্রথমে গিফট পাঠানোর কথা বলে এর একটা রিসিট হোয়াটস অ্যাপে দিয়েছে। সেই রিসিট পাঠানোর একদিন পরে ঢাকা থেকে একটা মেয়ে সালমা আকতার নাম দিয়ে কাস্টমস ইন্সপেক্টর পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করে। সে বলতেছে, আপনার একটা গিফট এসেছে, এটার জন্য কাস্টম ডিউটি লাগবে ৬৫ হাজার টাকা।এই টাকা দেয়ার পর বলেছে যে আপনার গিফট বক্সের ভেতরে ডলার পাওয়া গেছে। সেজন্য এক লাখ ৮৫ হাজার টাকা দিতে হবে।এভাবে তিন কিস্তিতে আমি পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টাকা দিয়েছি।”
তিনি এই টাকাগুলো দিয়েছেন বাংলাদেশের কয়েকটি অ্যাকান্টের মাধ্যমে।
ফরহাদ হোসেন বলেছেন, এত টাকা দেয়ার পর আবার টাকা চাইল তখন তার সন্দেহ হয়। তিনি গুলশান থানায় একটি জিডি করেন এবং সিআইডি পুলিশকে জানান।
তিনি জানিয়েছেন, ঢাকার যে সব ফোন নম্বর থেকে তার কাছ থেকে কাস্টমস কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে টাকা নেয়া হয়েছে। সেগুলোর সূত্র ধরে সিআইডি পুলিশ ১৫জন নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেফতার করেছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যারয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সুমনা শারমিন মনে করেন, সামাজিক মাধ্যমে প্রথমে আগ্রহ এবং তারপর লোভের কারণে অনেক মানুষ এসব চক্রের শিকার হচ্ছে।
তবে এ ধরণের অপরাধী চক্র বাংলাদেশে কিভাবে আসছে বা অবস্থান করতে পারে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
পুলিশ বলেছে, এই চক্র শুধু বাংলাদেশ নয়, বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে একই রকম প্রতারণা করেছে।
সিআইডি পুলিশের কর্মকর্তা শেখ রেজাউল হায়দার বলেছেন, “আমরা এখনও অ্যানালিসিস পর্যায়ে আছি। এরপরও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তারা কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় যেমন ভারত, সিঙ্গাপুর দুবাইয়ে জার্নি করেছে। তাদের ফেক আইডি দিয়ে যে কনভারসেশনগুলো আছে, তাতে ভারত এবং দুবাইতে তারা কিছু ভিকটিমের সাথে একই রকম কথা বলছে। যা দেখা যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেছেন, “গত দেড় মাসে ৪০ জনের বেশি নাইজেরিয়ান গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের একটা বড় অংশ এসেছে বিজনেস ভিসায় এবং এক দুইজন পাওয়া গেছে, যারা স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছে। সেক্ষেত্রে এখান থেকে কেউ না কেই স্পন্সর হচ্ছে। সেজন্য এই বিষয়গুলো আরও গভীরে খতিয়ে দেখা হবে।”
পুলিশ কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, প্রতারণা মামলায় এখন তদন্ত চলছে এবং সেই তদন্তেই নানা প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা থাকবে।