Dhaka , Wednesday, 17 April 2024

মূল্য নেই নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকার

  • Robiul Islam
  • আপডেট টাইম : 08:32:59 am, Sunday, 15 January 2023
  • 46 বার

আর্থনীতি ডেস্ক: রাজধানীর কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তালিকা প্রকাশ করে থাকে। আর এসব তালিকার একটির দামের সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই।

শুধু তাই নয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বাজারগুলোতে তালিকা টানানোর বিধান থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা অনুপস্থিত। এমনকি তালিকা অনুযায়ী দ্রব্যমূল্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব আছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কিন্তু সেটিরও নেই তেমন কোনো কার্যকারিতা।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো তালিকার তোয়াক্কা না করে বিক্রেতারা খেয়াল-খুশিমতো দাম রাখছেন। আর উচ্চমূল্যে পণ্য কিনে হাঁসফাঁস অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে অসহায় ক্রেতাদের। তাদের মন্তব্য-সরকারের এই ধরনের তালিকা প্রকাশ করা আর না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ এর কোনো মূল্যই নেই।

ঢাকার বিভিন্ন বাজার সরেজমিন ঘুরে, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একদিনের মূল্য তালিকা বিশ্লেষণ করে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।

জানা গেছে, প্রতিদিনের বাজারের মূল্য তালিকা প্রকাশ করে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। পাশাপাশি প্রত্যেক বাজারে বড় সাইন বোর্ডে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মূল্য তালিকা টানিয়ে দেওয়া এবং দোকানগুলোতে আলাদাভাবে মূল্য তালিকা টানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যা ২০০০ সালের আগ থেকে কার্যকর আছে।

রোববার টিসিবির দৈনিক বাজার মূল্য তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে প্রতি হালি ফার্মের মুরগির ডিমের দাম দেওয়া ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল্য তালিকায় প্রতি হালি ডিমের দাম দেওয়া ছিল ৩৭ টাকা। একই দিন টাউনহল বাজারে প্রতি হালি ডিম ৪২ থেকে ৪৬ টাকা করে বিক্রি হয়েছে।

ওইদিন টিসিবির তালিকায় গরুর মাংসের দাম দেওয়া হয় ৬৬০ থেকে ৭০০ টাকা। আর কৃষি বিপণনের তালিকায় দেওয়া হয় ৬৯০ টাকা। ওইদিন নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের মাংসের দোকানগুলোতে ৭০০ টাকা করে গরুর মাংস বিক্রি করা। টিসিবির তালিকায় প্রতি কেজি ছোট দানার মসুর ডালের মূল্য ছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। আর কৃষি বিপণননের মূল্য তালিকায় ছিল ১৩৯ টাকা।

গুলশান-২ সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজারে ছোট দানার প্রতি কেজি মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১৪৫ টাকায়। টিসিবির তালিকায় কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। আর কৃষি বিপণনের তারিকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪৩ কোটি টাকা। আর মোহাম্মদপুর টাউনহল বাজারে কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ৪৭ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়।

টিসিবির তালিকায় মুগডালের দাম দেওয়া হয় ৯৫ থেকে ১৩৫ টাকা। আর কৃষি বিপণনের তালিকায় দাম ছিল ১২৩ টাকা। আর নিউমার্কেটে প্রতি কেজি মুগডাল ১২০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা যায়। টিসিবির তালিকায় কেজিপ্রতি চিনির দাম ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। কৃষি বিপণনের তালিকায় ছিল ১৩৫ টাকা। মোহাম্মদপুর টাউনহল বাজারে কেজিপ্রতি চিনির দাম ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। টিসিবির তালিকায় রুই কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা।

কৃষি বিপণের তালিকায় কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩২০ টাকা। ওইদিন মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে কেজিপ্রতি রুই ৩৭০ থেকে ৪২০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়।

শুধু রোববারই নয়, অন্যান্য দিনও প্রতিষ্ঠান দুটির মূল্য তালিকায় অমিল থাকে। পাশাপাশি দুই তালিকার সঙ্গে বাজারদরেরও কোনো মিল থাকে না।

এই প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর যে তথ্য প্রকাশ করবে, সেটা খুবই যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করা উচিত। তা হলে সবাই বাজারের বাস্তব অবস্থা বুঝতে পারবে। টিসিবি এবং কৃষি বিপণনের নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা প্রকাশে কোনো ত্রুটি থাকলে তার ব্যাখ্যা তাদের দিতে হবে।

তিনি বলেন, কাঁচাবাজারগুলোতে মূল্য তালিকা টানানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। বহুদিন থেকে এক্ষেত্রে ত্রুটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভোক্তার নায্যমূল্যে পণ্য ক্রয় নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনকে নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে।

টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির বলেন, টিসিবি প্রতিদিন সকালে রাজধানীর কিছু বাজার পরিদর্শন করে ওই সময়ের মূল্য তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে থাকে। পরে ওইসব পণ্যের দাম কোনো কারণে বাড়তে বা কমতে পারে। তবে কৃষি বিপণন কোনো মার্কেট থেকে কখন তথ্য সংগ্রহ করে থাকে, সেটা আমাদের জানার কথা নয়। ভিন্ন মার্কেট বা ভিন্ন সময় হলে পণ্যের দাম কমবেশি হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পরিচালক (গবেষণা ও রপ্তানি উন্নয়ন) শাহনাজ বেগম নীনা বলেন, কৃষি বিপণন রাজধানীর বেশকিছু মার্কেটের ওইদিনের নিত্যপণ্য বিক্রির দাম পর্যালোচনা করে একটি তালিকা করে। ওই তালিকা ওইদিন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। টিসিবির সঙ্গে আমাদের নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকায় কোনো পার্থক্য থাকে কিনা, সেটা কখনো তুলনা করে দেখা হয়নি। এটা আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। কোনো ত্রুটি থাকলে সংশোধন করার চেষ্টা করা হবে।

তিনি আরও বলেন, কৃষি বিপণন সকালে বাজারগুলো থেকে মূল্য তালিকা সংগ্রহ করে ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করে থাকে। সময় ও বাজারভেদে নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা আলাদা হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

সরেজমিন রাজধানীর কাঁচাবাজার : রাজধানীর ৬টি কাঁচাবাজার সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। এসময় মূল্য তালিকা না মানার চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। নিউমর্কেট কাঁচাবাজারে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দোকানে মূল্য তালিকা টাঙানো নেই। হাতেগোনা কয়েকটি দোকানে মূল্য তালিকা টাঙানো থাকলেও সেগুলো ৩ থেকে ৫ দিনে আগের।

নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মাহবুব হোসেন জানান, কাঁচামালের মূল্য প্রতিদিনই ওঠানামা করে। নানা রকমের তরকারি ও সবজি বিক্রি করি আমরা। প্রথমে কিছুদিন মূল্য তালিকা টানানো হয়েছিল। খুবই কষ্টকর বলে এখন আর করা হয় না। সিটি করপোরেশেনর লোক মাঝেমধ্যে আসে। তারা টাঙানোর পরামর্শ দেন; কিন্তু আমাদের অলসতার কারণে মানা হচ্ছে না। তবে এটা বলতে পারি যে, আমরা গ্রাহকদের থেকে বেশি দাম নেই না।

নিউ মার্কেট কাঁচাবাজারের মাছ ব্যবসায়ী মো. জনি মিয়া জানান, মূল্য তালিকা ছিল, কিন্তু কিছুদিন ধরে এটা মানা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে মূল্য তালিকা টানিয়ে মাছ বিক্রি করবেন বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

সরেজমিন রাজধানীর কাওরান বাজারে দেখা গেছে, কোথাও মূল্য তালিকা নেই। এখানে পাইকারি ও খুচরা দুই ধরনের কাঁচাবাজার রয়েছে। কোনো বাজারেই মূল্য তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়ীরা জানান, একদামে ক্রেতারা জিনিসপত্র কিনতে চান না। এজন্য তারা মূল্য তালিকা টানান না। কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী সুজন মাদবর জানান, মূল্য তালিকা টানানো ঝামেলার কাজ। এজন্য হয় না। আর ক্রেতারাও একদামে জিনিস কিনতে চান না। মূল্য তালিকা টাঙানো থাকলেও দামাদামি করেন।

ঘুরে দেখা হয় অভিজাত গুলশান-২ নম্বর কাঁচাবাজার। উত্তর সিটি করপোরেশনের নগর ভবনসংলগ্ন এই কাঁচাবাজারের কোনো দোকানে মূল্য তালিকা নেই। এই মার্কেটের নূর হোসেন ভেজিটেবল স্টোরের বিক্রেতা মো. নূর হোসেন মূল্য তালিকা না টানানোর কারণ জানতে চাইলে বলেন, টানানো হয়, তবে আজ (মঙ্গলবার) ভুলবশত হয়নি। ব্যতিক্রমী চিত্র লক্ষ্য করা গেছে, রাজধানীর হাতিরপুল বাজারে। সব ধরনের দোকানে হালনাগাদ মূল্য তালিকা আছে। ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এই নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ওই বাজারের সিটি করপোরেশনের তদারকিও বেশি।

নিউমার্কেটে আজিমপুর এলাকার গৃহবধূ বিলকিস খাতুন জানান, বাজারে সবজির দ্বিগুণ-তিনগুণ দাম চান ব্যবসায়ীরা। বাসা থেকে যে পরিকল্পনা করে কাঁচাবাজারে ঢোকেন, জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় পরিকল্পনামাফিক জিনিস কিনতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, কাঁচাবাজারের দোকানগুলোয় মূল্য তালিকা টানানোর কথা থাকলেও বিক্রেতারা সেসব মানছেন না। ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামাফিক দাম আদায় করছেন গ্রাহকদের থেকে।

টাউনহল মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ দোকানে মূল্য তালিকা টানানো আছে। তবে কিছু দোকানে এক সপ্তাহ বা ৫ দিন আগের তালিকা ঝুলতে দেখা গেছে। বাজারের গেটে সিটি করপোরেশনের মূল্য তালিকা নেই। মূল্য তালিকা রয়েছে, এমন দোকানোগুলোয় একই পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন দাম লক্ষ্য করা গেছে। টাউনহল কাঁচাবাজারের ‘নেপচুন বাজার’ নামের দোকানের বিক্রেতা মো. সোহেল জানান, ভোক্তা অধিকারের মামলা খাওয়ার পর থেকে নিয়মিত মূল্য তালিকা টানাই আমরা। কেনা-বিক্রি দামের মধ্যে পার্থক্য আমরা আশপাশের দোকানের সঙ্গে মিল রেখে করে থাকি। এ কারণে দোকানভেদে দামের কিছুটা তফাত হয়ে থাকতে পারে।

মোহাম্মদপুর টাউনহল কাঁচাবাজার বণিক সমিতির সহসভাপতি মুজিবুর রহমান জানান, সব দোকানদারকে সরকারি নির্দেশনা মেনে পণ্যমূল্য টাঙানো ও বিক্রি করতে নিয়মিত মাইকিং করা হয়। এরপরও কেউ ব্যত্যয় করলে আমাদের কি করার আছে। তবে আমার মনে হয় আমাদের বাজার অন্যান্য অনেক বাজারের তুলনায় সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলার চেষ্টা করে।

একই চিত্র দেখা গেছে সিটি করপোরেশনের মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজারে। সাড়ে তিন বছর আগে সিটি করপোরেশন একটি মূল্য তালিকার বোর্ড স্থাপন করলেও সেটা হালনাগাদ করা হয় না। সাইনবোর্ডটির একাংশ খুলে গেছে। যে কোনো সময় মূল কাঠামো থেকে বাজারের মূল্য তালিকার বোর্ডটি খুলে পড়তে পারে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সামনের দোকানগুলো নিয়মিত মূল্য তালিকা টানালেও ভেতরের দোকানগুলো মূল্য তালিকা টানাচ্ছে না। কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, নিয়মিত মূল্য তালিকা টানানো বিরক্তিকর। তারা মূল্য তালিকা টানালেও ক্রেতা ওই দামে পণ্য কেনেন না। এজন্য তাদের কাছে বিষয়টি ঝামেলাপূর্ণ মনে হয়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী জানান, দক্ষিণ সিটির কাঁচাবাজারগুলোয় মূল্য তালিকা নিশ্চিত করতে তদারকি করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা মূল্য তালিকা মানেন না। এজন্য প্রায়ই মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হয়। ভবিষ্যতে এই কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আ ন ম তরিকুল ইসলাম জানান, সিটি করপোরেশনে তিনি কিছুদিন আগে যোগদান করেছেন। এখনো সববিষয় তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। কাঁচাবাজারের মূল্য তালিকা টাঙানোর বিষয়টি তিনি খবর নিয়ে দেখবেন। কোনো ধরনের ব্যত্যয় থাকলে, তা সংশোধনে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Robiul Islam

মূল্য নেই নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকার

আপডেট টাইম : 08:32:59 am, Sunday, 15 January 2023

আর্থনীতি ডেস্ক: রাজধানীর কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তালিকা প্রকাশ করে থাকে। আর এসব তালিকার একটির দামের সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই।

শুধু তাই নয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বাজারগুলোতে তালিকা টানানোর বিধান থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা অনুপস্থিত। এমনকি তালিকা অনুযায়ী দ্রব্যমূল্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব আছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কিন্তু সেটিরও নেই তেমন কোনো কার্যকারিতা।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো তালিকার তোয়াক্কা না করে বিক্রেতারা খেয়াল-খুশিমতো দাম রাখছেন। আর উচ্চমূল্যে পণ্য কিনে হাঁসফাঁস অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে অসহায় ক্রেতাদের। তাদের মন্তব্য-সরকারের এই ধরনের তালিকা প্রকাশ করা আর না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ এর কোনো মূল্যই নেই।

ঢাকার বিভিন্ন বাজার সরেজমিন ঘুরে, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একদিনের মূল্য তালিকা বিশ্লেষণ করে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।

জানা গেছে, প্রতিদিনের বাজারের মূল্য তালিকা প্রকাশ করে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। পাশাপাশি প্রত্যেক বাজারে বড় সাইন বোর্ডে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মূল্য তালিকা টানিয়ে দেওয়া এবং দোকানগুলোতে আলাদাভাবে মূল্য তালিকা টানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যা ২০০০ সালের আগ থেকে কার্যকর আছে।

রোববার টিসিবির দৈনিক বাজার মূল্য তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে প্রতি হালি ফার্মের মুরগির ডিমের দাম দেওয়া ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল্য তালিকায় প্রতি হালি ডিমের দাম দেওয়া ছিল ৩৭ টাকা। একই দিন টাউনহল বাজারে প্রতি হালি ডিম ৪২ থেকে ৪৬ টাকা করে বিক্রি হয়েছে।

ওইদিন টিসিবির তালিকায় গরুর মাংসের দাম দেওয়া হয় ৬৬০ থেকে ৭০০ টাকা। আর কৃষি বিপণনের তালিকায় দেওয়া হয় ৬৯০ টাকা। ওইদিন নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের মাংসের দোকানগুলোতে ৭০০ টাকা করে গরুর মাংস বিক্রি করা। টিসিবির তালিকায় প্রতি কেজি ছোট দানার মসুর ডালের মূল্য ছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। আর কৃষি বিপণননের মূল্য তালিকায় ছিল ১৩৯ টাকা।

গুলশান-২ সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজারে ছোট দানার প্রতি কেজি মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১৪৫ টাকায়। টিসিবির তালিকায় কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। আর কৃষি বিপণনের তারিকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪৩ কোটি টাকা। আর মোহাম্মদপুর টাউনহল বাজারে কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ৪৭ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়।

টিসিবির তালিকায় মুগডালের দাম দেওয়া হয় ৯৫ থেকে ১৩৫ টাকা। আর কৃষি বিপণনের তালিকায় দাম ছিল ১২৩ টাকা। আর নিউমার্কেটে প্রতি কেজি মুগডাল ১২০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা যায়। টিসিবির তালিকায় কেজিপ্রতি চিনির দাম ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। কৃষি বিপণনের তালিকায় ছিল ১৩৫ টাকা। মোহাম্মদপুর টাউনহল বাজারে কেজিপ্রতি চিনির দাম ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। টিসিবির তালিকায় রুই কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা।

কৃষি বিপণের তালিকায় কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩২০ টাকা। ওইদিন মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে কেজিপ্রতি রুই ৩৭০ থেকে ৪২০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়।

শুধু রোববারই নয়, অন্যান্য দিনও প্রতিষ্ঠান দুটির মূল্য তালিকায় অমিল থাকে। পাশাপাশি দুই তালিকার সঙ্গে বাজারদরেরও কোনো মিল থাকে না।

এই প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর যে তথ্য প্রকাশ করবে, সেটা খুবই যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করা উচিত। তা হলে সবাই বাজারের বাস্তব অবস্থা বুঝতে পারবে। টিসিবি এবং কৃষি বিপণনের নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা প্রকাশে কোনো ত্রুটি থাকলে তার ব্যাখ্যা তাদের দিতে হবে।

তিনি বলেন, কাঁচাবাজারগুলোতে মূল্য তালিকা টানানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। বহুদিন থেকে এক্ষেত্রে ত্রুটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভোক্তার নায্যমূল্যে পণ্য ক্রয় নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনকে নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে।

টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির বলেন, টিসিবি প্রতিদিন সকালে রাজধানীর কিছু বাজার পরিদর্শন করে ওই সময়ের মূল্য তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে থাকে। পরে ওইসব পণ্যের দাম কোনো কারণে বাড়তে বা কমতে পারে। তবে কৃষি বিপণন কোনো মার্কেট থেকে কখন তথ্য সংগ্রহ করে থাকে, সেটা আমাদের জানার কথা নয়। ভিন্ন মার্কেট বা ভিন্ন সময় হলে পণ্যের দাম কমবেশি হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পরিচালক (গবেষণা ও রপ্তানি উন্নয়ন) শাহনাজ বেগম নীনা বলেন, কৃষি বিপণন রাজধানীর বেশকিছু মার্কেটের ওইদিনের নিত্যপণ্য বিক্রির দাম পর্যালোচনা করে একটি তালিকা করে। ওই তালিকা ওইদিন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। টিসিবির সঙ্গে আমাদের নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকায় কোনো পার্থক্য থাকে কিনা, সেটা কখনো তুলনা করে দেখা হয়নি। এটা আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। কোনো ত্রুটি থাকলে সংশোধন করার চেষ্টা করা হবে।

তিনি আরও বলেন, কৃষি বিপণন সকালে বাজারগুলো থেকে মূল্য তালিকা সংগ্রহ করে ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করে থাকে। সময় ও বাজারভেদে নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা আলাদা হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

সরেজমিন রাজধানীর কাঁচাবাজার : রাজধানীর ৬টি কাঁচাবাজার সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। এসময় মূল্য তালিকা না মানার চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। নিউমর্কেট কাঁচাবাজারে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দোকানে মূল্য তালিকা টাঙানো নেই। হাতেগোনা কয়েকটি দোকানে মূল্য তালিকা টাঙানো থাকলেও সেগুলো ৩ থেকে ৫ দিনে আগের।

নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মাহবুব হোসেন জানান, কাঁচামালের মূল্য প্রতিদিনই ওঠানামা করে। নানা রকমের তরকারি ও সবজি বিক্রি করি আমরা। প্রথমে কিছুদিন মূল্য তালিকা টানানো হয়েছিল। খুবই কষ্টকর বলে এখন আর করা হয় না। সিটি করপোরেশেনর লোক মাঝেমধ্যে আসে। তারা টাঙানোর পরামর্শ দেন; কিন্তু আমাদের অলসতার কারণে মানা হচ্ছে না। তবে এটা বলতে পারি যে, আমরা গ্রাহকদের থেকে বেশি দাম নেই না।

নিউ মার্কেট কাঁচাবাজারের মাছ ব্যবসায়ী মো. জনি মিয়া জানান, মূল্য তালিকা ছিল, কিন্তু কিছুদিন ধরে এটা মানা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে মূল্য তালিকা টানিয়ে মাছ বিক্রি করবেন বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

সরেজমিন রাজধানীর কাওরান বাজারে দেখা গেছে, কোথাও মূল্য তালিকা নেই। এখানে পাইকারি ও খুচরা দুই ধরনের কাঁচাবাজার রয়েছে। কোনো বাজারেই মূল্য তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়ীরা জানান, একদামে ক্রেতারা জিনিসপত্র কিনতে চান না। এজন্য তারা মূল্য তালিকা টানান না। কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী সুজন মাদবর জানান, মূল্য তালিকা টানানো ঝামেলার কাজ। এজন্য হয় না। আর ক্রেতারাও একদামে জিনিস কিনতে চান না। মূল্য তালিকা টাঙানো থাকলেও দামাদামি করেন।

ঘুরে দেখা হয় অভিজাত গুলশান-২ নম্বর কাঁচাবাজার। উত্তর সিটি করপোরেশনের নগর ভবনসংলগ্ন এই কাঁচাবাজারের কোনো দোকানে মূল্য তালিকা নেই। এই মার্কেটের নূর হোসেন ভেজিটেবল স্টোরের বিক্রেতা মো. নূর হোসেন মূল্য তালিকা না টানানোর কারণ জানতে চাইলে বলেন, টানানো হয়, তবে আজ (মঙ্গলবার) ভুলবশত হয়নি। ব্যতিক্রমী চিত্র লক্ষ্য করা গেছে, রাজধানীর হাতিরপুল বাজারে। সব ধরনের দোকানে হালনাগাদ মূল্য তালিকা আছে। ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এই নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ওই বাজারের সিটি করপোরেশনের তদারকিও বেশি।

নিউমার্কেটে আজিমপুর এলাকার গৃহবধূ বিলকিস খাতুন জানান, বাজারে সবজির দ্বিগুণ-তিনগুণ দাম চান ব্যবসায়ীরা। বাসা থেকে যে পরিকল্পনা করে কাঁচাবাজারে ঢোকেন, জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় পরিকল্পনামাফিক জিনিস কিনতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, কাঁচাবাজারের দোকানগুলোয় মূল্য তালিকা টানানোর কথা থাকলেও বিক্রেতারা সেসব মানছেন না। ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামাফিক দাম আদায় করছেন গ্রাহকদের থেকে।

টাউনহল মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ দোকানে মূল্য তালিকা টানানো আছে। তবে কিছু দোকানে এক সপ্তাহ বা ৫ দিন আগের তালিকা ঝুলতে দেখা গেছে। বাজারের গেটে সিটি করপোরেশনের মূল্য তালিকা নেই। মূল্য তালিকা রয়েছে, এমন দোকানোগুলোয় একই পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন দাম লক্ষ্য করা গেছে। টাউনহল কাঁচাবাজারের ‘নেপচুন বাজার’ নামের দোকানের বিক্রেতা মো. সোহেল জানান, ভোক্তা অধিকারের মামলা খাওয়ার পর থেকে নিয়মিত মূল্য তালিকা টানাই আমরা। কেনা-বিক্রি দামের মধ্যে পার্থক্য আমরা আশপাশের দোকানের সঙ্গে মিল রেখে করে থাকি। এ কারণে দোকানভেদে দামের কিছুটা তফাত হয়ে থাকতে পারে।

মোহাম্মদপুর টাউনহল কাঁচাবাজার বণিক সমিতির সহসভাপতি মুজিবুর রহমান জানান, সব দোকানদারকে সরকারি নির্দেশনা মেনে পণ্যমূল্য টাঙানো ও বিক্রি করতে নিয়মিত মাইকিং করা হয়। এরপরও কেউ ব্যত্যয় করলে আমাদের কি করার আছে। তবে আমার মনে হয় আমাদের বাজার অন্যান্য অনেক বাজারের তুলনায় সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলার চেষ্টা করে।

একই চিত্র দেখা গেছে সিটি করপোরেশনের মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজারে। সাড়ে তিন বছর আগে সিটি করপোরেশন একটি মূল্য তালিকার বোর্ড স্থাপন করলেও সেটা হালনাগাদ করা হয় না। সাইনবোর্ডটির একাংশ খুলে গেছে। যে কোনো সময় মূল কাঠামো থেকে বাজারের মূল্য তালিকার বোর্ডটি খুলে পড়তে পারে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সামনের দোকানগুলো নিয়মিত মূল্য তালিকা টানালেও ভেতরের দোকানগুলো মূল্য তালিকা টানাচ্ছে না। কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, নিয়মিত মূল্য তালিকা টানানো বিরক্তিকর। তারা মূল্য তালিকা টানালেও ক্রেতা ওই দামে পণ্য কেনেন না। এজন্য তাদের কাছে বিষয়টি ঝামেলাপূর্ণ মনে হয়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী জানান, দক্ষিণ সিটির কাঁচাবাজারগুলোয় মূল্য তালিকা নিশ্চিত করতে তদারকি করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা মূল্য তালিকা মানেন না। এজন্য প্রায়ই মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হয়। ভবিষ্যতে এই কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আ ন ম তরিকুল ইসলাম জানান, সিটি করপোরেশনে তিনি কিছুদিন আগে যোগদান করেছেন। এখনো সববিষয় তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। কাঁচাবাজারের মূল্য তালিকা টাঙানোর বিষয়টি তিনি খবর নিয়ে দেখবেন। কোনো ধরনের ব্যত্যয় থাকলে, তা সংশোধনে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।