Dhaka , Thursday, 18 April 2024

ঋণ করে মালয়েশিয়ায় : বেতন পাওয়ার আগেই মাথায় ভারী মেশিন পড়ে মৃত্যু, নিঃস্ব পরিবার

  • Robiul Islam
  • আপডেট টাইম : 08:13:02 am, Monday, 13 February 2023
  • 52 বার

মালয়েশিয়া ডেস্ক: মাত্র একমাস আগে সাড়ে চার লাখ টাকা ঋণ করে মালয়েশিয়া যান মো. হৃদয় মণ্ডল। ২১ বছর বয়সী টগবগে এক প্রাণোচ্ছল যুবক। স্বপ্ন ছিল পরিবারে একটু সচ্ছলতা নিয়ে আসা। সেই আশায় ছিলেন পরিবারের সদস্যরাও। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেলো পরিবারটির। একটি টাকাও পরিবারকে দিতে পারেননি হৃদয় মণ্ডল। ঋণের টাকাও পরিশোধ হয়নি তার। তার আগেই দুর্ঘটনায় নিভে গেলো হৃদয় মন্ডলের প্রাণ। ফলে পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার!

গত ২৮ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করা অবস্থায় ওপর থেকে ভারী মেশিন শরীরের পড়ে গুরুতর আহত হন হৃদয়। তাকে সেলাংগর রাজ্যের বানতিং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে স্থানান্তর করা হয় ক্লাং হাসপাতালে। সেখানে ১৩ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টায় মৃত্যু হয় তার।

হৃদয় মণ্ডল সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার জামতৈল উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুস সালামের ছেলে।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ৩ জানুয়ারি মেগাটেক্স কোম্পানিতে বৈধকর্মী ভিসায় মালয়েশিয়ায় যান হৃদয় মণ্ডল। সেখানে সেলাংগরের বানতিং এলাকায় একটি প্লাস্টিকের কারখানায় চাকরি পান তিনি।

নিহত হৃদয়ের বোন সালমা খাতুন বলেন, আমরা দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে, বড় ভাই বছর দশেক আগে হারিয়ে যান। হৃদয় আমাদের ছোট। পরিবারের একমাত্র ভরসা হৃদয়কে ঋণ করে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে এক মাসের বেতন না পেতেই মারা গেলো হৃদয়।

নিহতের মামা আনোয়ার হোসেন বলেন, চার লাখ টাকা ঋণ করে মাত্র এক মাস ছয়দিন আগে তাকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। এখন পরিবারের অভাব দূর করা তো দূরে থাক, ঋণ শোধ করবে কীভাবে? এমনিতেই এই পরিবারে কোনো আয়-রোজগার নেই, জমিও নেই!

জামতৈল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন শেখ বলেন, ঘটনাটি মর্মান্তিক। এই পরিবারটি একেবারেই অসহায়। নিঃস্ব হয়ে গেলো তারা! হৃদয়ের বিধবা মা হুসনা খাতুন ধানের চাতালে কাজ করে কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের ভরণ-পোষণ করেন। কিন্তু আজ একে একে সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেলো।

জামতৈল ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওই পরিবারটিকে যথাসাধ্য সহায়তা করবো।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ঋণ করে বিদেশে না যেতে বলা হয়, কিন্তু বিদেশে যাওয়ার খরচ না দিলে তো যেতে পারবে না। যে যাই বলুক লাখ লাখ টাকা লাগে এটাই সত্য। টাকা না দিলে বিদেশ যেতে পারে না কেউ।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের জেলা সমন্বয়কারী ফাহমিদা আহসান বলেন, মালয়েশিয়ায় দুর্ঘটনায় নিহত হৃদয়ের পরিবারের পাশে আমরা আছি। হৃদয় কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গেছে, ওয়েজ বোর্ডের সদস্য হয়ে গেছে কি না, সঠিক কোম্পানিতে কাজ করতো কি না, তাকে অবৈধভাবে কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল কি না, তার ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ করে আমরা পরিবারটিকে সহযোগিতা করবো, যেন তারা ক্ষতিপূরণ পায়।

এদিকে হৃদয়ের মৃত্যুর বিষয়ে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম শাখার প্রথম সচিব এসএম জাহিদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হৃদয়ের মৃত্যুর বিষয়ে অফিসিয়ালি কোনো খবর পাইনি। হাইকমিশন থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শ্রম আইনে সব সুবিধাদি পাবেন হৃদয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী হিসেবে গমনের অতিরিক্ত খরচের বিষয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ড. আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, এটি দাসত্বের সমান। আন্তর্জাতিকভাবে ও অতিরিক্ত অভিবাসন খরচকে জবরদস্তি শ্রম এবং মানবপাচার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

এ দুটি বিষয়েই বাংলাদেশের আইনে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে এনআরবির চেয়ারপার্সন এমএস সেকিল চৌধুরী জানান।

তিনি বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে অভিবাসন খরচের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা আছে। সে মোতাবেক মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনে সিকিউরিটি ডিপোজিট, প্রসেসিং ফিস, ভিজিট পাস (অস্থায়ী কর্ম ভিসা), ইনস্যুরেন্স (কর্মস্থল দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্য, সকসো এবং অন্যান্য), মালয়েশিয়ায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা (ফোমেমা), বায়ো মেডিকেল ফি, ভিসা প্রসেসিং ফি, ওয়ার্কিং ভিসা ফি, বিমান টিকিট, বাংলাদেশ হাই কমিশনের এটেস্টেশন ফি, কোভিড টেস্ট ফি (প্রয়োজন হলে), কোয়ারেন্টিন খরচ (প্রয়োজন হলে), মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্সির ফি অর্থাৎ মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ বহন করবে নিয়োগকর্তা। এমনকি অনেক নিয়োগকর্তা শূন্য খরচে, অর্থাৎ কর্মীর এক টাকাও খরচ হবে না, এমন সুবিধা দিয়ে নিয়োগ করে বলে জানা গেছে।

অপরদিকে বাংলাদেশ প্রান্তে কর্মীর পাসপোর্ট করা, প্রাথমিক মেডিকেল, ওয়েজ বোর্ডের সদস্য হওয়া এবং বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস ফি ছাড়া আর কোনো খরচ নেই। অর্থাৎ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা খরচ হবে বলে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত নিহত হৃদয় মণ্ডল।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Robiul Islam

ঋণ করে মালয়েশিয়ায় : বেতন পাওয়ার আগেই মাথায় ভারী মেশিন পড়ে মৃত্যু, নিঃস্ব পরিবার

আপডেট টাইম : 08:13:02 am, Monday, 13 February 2023

মালয়েশিয়া ডেস্ক: মাত্র একমাস আগে সাড়ে চার লাখ টাকা ঋণ করে মালয়েশিয়া যান মো. হৃদয় মণ্ডল। ২১ বছর বয়সী টগবগে এক প্রাণোচ্ছল যুবক। স্বপ্ন ছিল পরিবারে একটু সচ্ছলতা নিয়ে আসা। সেই আশায় ছিলেন পরিবারের সদস্যরাও। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেলো পরিবারটির। একটি টাকাও পরিবারকে দিতে পারেননি হৃদয় মণ্ডল। ঋণের টাকাও পরিশোধ হয়নি তার। তার আগেই দুর্ঘটনায় নিভে গেলো হৃদয় মন্ডলের প্রাণ। ফলে পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার!

গত ২৮ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করা অবস্থায় ওপর থেকে ভারী মেশিন শরীরের পড়ে গুরুতর আহত হন হৃদয়। তাকে সেলাংগর রাজ্যের বানতিং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে স্থানান্তর করা হয় ক্লাং হাসপাতালে। সেখানে ১৩ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টায় মৃত্যু হয় তার।

হৃদয় মণ্ডল সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার জামতৈল উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুস সালামের ছেলে।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ৩ জানুয়ারি মেগাটেক্স কোম্পানিতে বৈধকর্মী ভিসায় মালয়েশিয়ায় যান হৃদয় মণ্ডল। সেখানে সেলাংগরের বানতিং এলাকায় একটি প্লাস্টিকের কারখানায় চাকরি পান তিনি।

নিহত হৃদয়ের বোন সালমা খাতুন বলেন, আমরা দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে, বড় ভাই বছর দশেক আগে হারিয়ে যান। হৃদয় আমাদের ছোট। পরিবারের একমাত্র ভরসা হৃদয়কে ঋণ করে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে এক মাসের বেতন না পেতেই মারা গেলো হৃদয়।

নিহতের মামা আনোয়ার হোসেন বলেন, চার লাখ টাকা ঋণ করে মাত্র এক মাস ছয়দিন আগে তাকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। এখন পরিবারের অভাব দূর করা তো দূরে থাক, ঋণ শোধ করবে কীভাবে? এমনিতেই এই পরিবারে কোনো আয়-রোজগার নেই, জমিও নেই!

জামতৈল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন শেখ বলেন, ঘটনাটি মর্মান্তিক। এই পরিবারটি একেবারেই অসহায়। নিঃস্ব হয়ে গেলো তারা! হৃদয়ের বিধবা মা হুসনা খাতুন ধানের চাতালে কাজ করে কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের ভরণ-পোষণ করেন। কিন্তু আজ একে একে সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেলো।

জামতৈল ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওই পরিবারটিকে যথাসাধ্য সহায়তা করবো।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ঋণ করে বিদেশে না যেতে বলা হয়, কিন্তু বিদেশে যাওয়ার খরচ না দিলে তো যেতে পারবে না। যে যাই বলুক লাখ লাখ টাকা লাগে এটাই সত্য। টাকা না দিলে বিদেশ যেতে পারে না কেউ।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের জেলা সমন্বয়কারী ফাহমিদা আহসান বলেন, মালয়েশিয়ায় দুর্ঘটনায় নিহত হৃদয়ের পরিবারের পাশে আমরা আছি। হৃদয় কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গেছে, ওয়েজ বোর্ডের সদস্য হয়ে গেছে কি না, সঠিক কোম্পানিতে কাজ করতো কি না, তাকে অবৈধভাবে কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল কি না, তার ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ করে আমরা পরিবারটিকে সহযোগিতা করবো, যেন তারা ক্ষতিপূরণ পায়।

এদিকে হৃদয়ের মৃত্যুর বিষয়ে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম শাখার প্রথম সচিব এসএম জাহিদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হৃদয়ের মৃত্যুর বিষয়ে অফিসিয়ালি কোনো খবর পাইনি। হাইকমিশন থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শ্রম আইনে সব সুবিধাদি পাবেন হৃদয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী হিসেবে গমনের অতিরিক্ত খরচের বিষয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ড. আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, এটি দাসত্বের সমান। আন্তর্জাতিকভাবে ও অতিরিক্ত অভিবাসন খরচকে জবরদস্তি শ্রম এবং মানবপাচার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

এ দুটি বিষয়েই বাংলাদেশের আইনে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে এনআরবির চেয়ারপার্সন এমএস সেকিল চৌধুরী জানান।

তিনি বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে অভিবাসন খরচের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা আছে। সে মোতাবেক মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনে সিকিউরিটি ডিপোজিট, প্রসেসিং ফিস, ভিজিট পাস (অস্থায়ী কর্ম ভিসা), ইনস্যুরেন্স (কর্মস্থল দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্য, সকসো এবং অন্যান্য), মালয়েশিয়ায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা (ফোমেমা), বায়ো মেডিকেল ফি, ভিসা প্রসেসিং ফি, ওয়ার্কিং ভিসা ফি, বিমান টিকিট, বাংলাদেশ হাই কমিশনের এটেস্টেশন ফি, কোভিড টেস্ট ফি (প্রয়োজন হলে), কোয়ারেন্টিন খরচ (প্রয়োজন হলে), মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্সির ফি অর্থাৎ মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ বহন করবে নিয়োগকর্তা। এমনকি অনেক নিয়োগকর্তা শূন্য খরচে, অর্থাৎ কর্মীর এক টাকাও খরচ হবে না, এমন সুবিধা দিয়ে নিয়োগ করে বলে জানা গেছে।

অপরদিকে বাংলাদেশ প্রান্তে কর্মীর পাসপোর্ট করা, প্রাথমিক মেডিকেল, ওয়েজ বোর্ডের সদস্য হওয়া এবং বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস ফি ছাড়া আর কোনো খরচ নেই। অর্থাৎ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা খরচ হবে বলে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত নিহত হৃদয় মণ্ডল।