Dhaka , Friday, 29 March 2024

আবার জীবন শুরু হোক জীবনের নিয়মে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : 05:39:35 am, Monday, 1 June 2020
  • 547 বার

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হওয়ার পর সরকার ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। আর সেদিন থেকেই হোম কোয়ারেন্টিনে আমি। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। তারপরও অফিস করেছি ২৫ মার্চ পর্যন্ত। এর মধ্যে অবশ্য একদিনের জন্য অফিসের কাজে গিয়েছিলাম যশোর আর সিলেট। তবে শোবিজে কাজ করেছি ১৭ মার্চ পর্যন্ত। সেদিন শেষ কাজ করেছিলাম একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ওভিসিতে। কাজ করার কথা ছিল ২৮ মার্চ পর্যন্ত ঈদের জন্য কয়েকটা নাটকের। কিন্তু ১৮ মার্চ থেকেই প্যাকআপ হতে শুরু করে সেই কাজগুলো।

অদৃশ্য আর প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা টের পাচ্ছিলাম গত ডিসেম্বর থেকেই। কিন্তু তখনও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি কী করে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব আমরা। আমাদের কোনোরকম প্রস্তুতিও ছিল না সেই অর্থে। তারপরও সময় আর জীবন কোনো কিছুই কখনও থেমে থাকে না। মাসাধিককাল হোম কোয়ারেন্টিনে থেকে নতুন পদ্ধতিতে অফিসের কাজ করলাম ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নামে।

কাজ করি দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের কমিউনিকেশন্স বিভাগের প্রধান পদে। আর তাই এখনকার ডিজিটাল পৃথিবীতে বাসায় বসে অফিসের কোনো কাজই আর বাকি থাকেনি করার। কিন্তু এই সময়ে ভীষণভাবে মিস করছি শোবিজের কাজকে। এ বছরটা শুরু হয়েছিল অনেক ব্যস্ততার মধ্যে। নাটক, টেলিফিল্ম, বিজ্ঞাপনের কাজ দিয়ে। ঈদের জন্যও কাজ করা শুরু করেছিলাম। প্রায় পাঁচ বছর আগে আমি যখন এই শোবিজে এসেছিলাম তখন কখনও ভাবিনি এই মায়ার জগতে এভাবে জড়িয়ে পড়ব।

কাজ করতে গিয়ে কত মানুষের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছে এ সময়ে। তাদের কেউ পরিচালক, কেউ সহকারী পরিচালক, কেউ অভিনয়শিল্পী, কেউ ডিওপি, কেউ লাইটম্যান, কেউ মেকআপ ম্যান, কেউ প্রোডাকশন বয়- কত মানুষ। কত গল্প, কত কথা, কত স্মৃতি তাদের সঙ্গে। এ সময়ে একটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি। এ জগতের মানুষ অনেক আবেগপ্রবণ আর সৃজনশীল। আর তাই তারা কখনও কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না, নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আর স্বকীয়তার জন্য। অথচ বাস্তবতা হল, তারা কিন্তু প্রতিদিনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

প্রত্যেকেরই কাজ না থাকলে উপার্জন থাকে না। ভাবা যায়, যে সেক্টরের মানুষ প্রতিবছর এতগুলো চ্যানেলের জন্য কত সৃজনশীল প্রোগ্রাম করছেন, তাদের জীবিকা কত অনিশ্চিত! তাদের নেই কোনো উৎসব ভাতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি ভাতা বা অবসর ভাতা। তারপরও এই মায়ার জগৎটা মনে হয় এমনই। এভাবেই চলে আসছে বহুদিন ধরে। যেখান থেকে ফেরা হয় না, ফেরা যায় না। সবাই মিলে কেমন এক অদৃশ্য পরিবার।

সেই পরিবারটা আজ স্তব্ধ, থেমে আছে। সবাই যার যার ঘরে বসে আছে কর্মহীন হয়ে। উত্তরা বা পুবাইলের শুটিং পাড়া আজ শূন্য। নেই কোনো নাটকের সেট, নেই কোনো লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশন। শোবিজের এত বড় একটা ক্ষেত্রের এতগুলো মানুষ আজ কর্মহীন হয়ে অলস জীবন পার করছে এক বিশাল অনিশ্চয়তায়।

বর্তমান সময়ের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ পদ্ধতিতে সব কাজই হয়তো কম আর বেশি করা যায় বাসায় থেকে। শুধু শোবিজের কাজ ছাড়া। কারণ এই শোবিজের কাজটা হল একটা বিশাল টিমওয়ার্ক, যেখানে একজন পরিচালক থেকে শুরু করে প্রোডাকশন বয় পর্যন্ত অনেক মানুষ জড়িত প্রতিটি প্রোজেক্টে।

আর তাই হোম কোয়ারেন্টিনে থেকেও অনেকে আজ লেখালেখি করছেন, গান গাইছেন, কবিতা আবৃত্তি করছেন, ছবি আঁকছেন, বই পড়ছেন, ইন্টারভিউ দিচ্ছেন, টকশো করছেন, অফিসের বিভিন্ন কাজ করছেন, ডাক্তাররা অনলাইনে রোগী দেখছেন। সবাই সব করছেন। শুধু কাজ হচ্ছে না অভিনয় জগতের। সব টিভিতেই এখন রিপিট প্রোগ্রাম হচ্ছে, পুরনো নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে।

এভাবেই পার করেছি আমরা বাংলা নববর্ষ। হয়তো আসন্ন ঈদও আমরা এভাবে পার করব পুরনো সব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দেখে। অথচ এখন এই সময়ে কত কাজ হওয়ার কথা ছিল। কত ব্যস্ত থাকে ঈদের এ সময়টা। এটাই তো ছিল কাজের সবচেয়ে বড় একটা মৌসুম।

একদিন হয়তো এই ঝড় থেমে যাবে। মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। সবাই আবার ফিরে যাবে কাজে। আবার কাজ শুরু হবে এই রুপালি শোবিজে। লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশনে মুখরিত হবে শুটিং পাড়া। কিন্তু যে শূন্যতা, অনিশ্চয়তা আর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এই শোবিজে গত দুই মাস ধরে, তা কি আমরা সবাই কাটিয়ে উঠতে পারব?

কেউই কিন্তু জানি না, আর কতদিন আমরা এভাবে থেমে থাকব। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এত বড় একটা ক্ষেত্র, তারপরও নেই কোনো সরকারি সহায়তা বা প্রণোদনা। আবার জীবন শুরু হোক জীবনের নিয়মে। হাসি, আনন্দ আর কোলাহলে। লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশনে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

আবার জীবন শুরু হোক জীবনের নিয়মে

আপডেট টাইম : 05:39:35 am, Monday, 1 June 2020

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হওয়ার পর সরকার ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। আর সেদিন থেকেই হোম কোয়ারেন্টিনে আমি। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। তারপরও অফিস করেছি ২৫ মার্চ পর্যন্ত। এর মধ্যে অবশ্য একদিনের জন্য অফিসের কাজে গিয়েছিলাম যশোর আর সিলেট। তবে শোবিজে কাজ করেছি ১৭ মার্চ পর্যন্ত। সেদিন শেষ কাজ করেছিলাম একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ওভিসিতে। কাজ করার কথা ছিল ২৮ মার্চ পর্যন্ত ঈদের জন্য কয়েকটা নাটকের। কিন্তু ১৮ মার্চ থেকেই প্যাকআপ হতে শুরু করে সেই কাজগুলো।

অদৃশ্য আর প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা টের পাচ্ছিলাম গত ডিসেম্বর থেকেই। কিন্তু তখনও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি কী করে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব আমরা। আমাদের কোনোরকম প্রস্তুতিও ছিল না সেই অর্থে। তারপরও সময় আর জীবন কোনো কিছুই কখনও থেমে থাকে না। মাসাধিককাল হোম কোয়ারেন্টিনে থেকে নতুন পদ্ধতিতে অফিসের কাজ করলাম ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নামে।

কাজ করি দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের কমিউনিকেশন্স বিভাগের প্রধান পদে। আর তাই এখনকার ডিজিটাল পৃথিবীতে বাসায় বসে অফিসের কোনো কাজই আর বাকি থাকেনি করার। কিন্তু এই সময়ে ভীষণভাবে মিস করছি শোবিজের কাজকে। এ বছরটা শুরু হয়েছিল অনেক ব্যস্ততার মধ্যে। নাটক, টেলিফিল্ম, বিজ্ঞাপনের কাজ দিয়ে। ঈদের জন্যও কাজ করা শুরু করেছিলাম। প্রায় পাঁচ বছর আগে আমি যখন এই শোবিজে এসেছিলাম তখন কখনও ভাবিনি এই মায়ার জগতে এভাবে জড়িয়ে পড়ব।

কাজ করতে গিয়ে কত মানুষের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছে এ সময়ে। তাদের কেউ পরিচালক, কেউ সহকারী পরিচালক, কেউ অভিনয়শিল্পী, কেউ ডিওপি, কেউ লাইটম্যান, কেউ মেকআপ ম্যান, কেউ প্রোডাকশন বয়- কত মানুষ। কত গল্প, কত কথা, কত স্মৃতি তাদের সঙ্গে। এ সময়ে একটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি। এ জগতের মানুষ অনেক আবেগপ্রবণ আর সৃজনশীল। আর তাই তারা কখনও কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না, নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আর স্বকীয়তার জন্য। অথচ বাস্তবতা হল, তারা কিন্তু প্রতিদিনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

প্রত্যেকেরই কাজ না থাকলে উপার্জন থাকে না। ভাবা যায়, যে সেক্টরের মানুষ প্রতিবছর এতগুলো চ্যানেলের জন্য কত সৃজনশীল প্রোগ্রাম করছেন, তাদের জীবিকা কত অনিশ্চিত! তাদের নেই কোনো উৎসব ভাতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি ভাতা বা অবসর ভাতা। তারপরও এই মায়ার জগৎটা মনে হয় এমনই। এভাবেই চলে আসছে বহুদিন ধরে। যেখান থেকে ফেরা হয় না, ফেরা যায় না। সবাই মিলে কেমন এক অদৃশ্য পরিবার।

সেই পরিবারটা আজ স্তব্ধ, থেমে আছে। সবাই যার যার ঘরে বসে আছে কর্মহীন হয়ে। উত্তরা বা পুবাইলের শুটিং পাড়া আজ শূন্য। নেই কোনো নাটকের সেট, নেই কোনো লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশন। শোবিজের এত বড় একটা ক্ষেত্রের এতগুলো মানুষ আজ কর্মহীন হয়ে অলস জীবন পার করছে এক বিশাল অনিশ্চয়তায়।

বর্তমান সময়ের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ পদ্ধতিতে সব কাজই হয়তো কম আর বেশি করা যায় বাসায় থেকে। শুধু শোবিজের কাজ ছাড়া। কারণ এই শোবিজের কাজটা হল একটা বিশাল টিমওয়ার্ক, যেখানে একজন পরিচালক থেকে শুরু করে প্রোডাকশন বয় পর্যন্ত অনেক মানুষ জড়িত প্রতিটি প্রোজেক্টে।

আর তাই হোম কোয়ারেন্টিনে থেকেও অনেকে আজ লেখালেখি করছেন, গান গাইছেন, কবিতা আবৃত্তি করছেন, ছবি আঁকছেন, বই পড়ছেন, ইন্টারভিউ দিচ্ছেন, টকশো করছেন, অফিসের বিভিন্ন কাজ করছেন, ডাক্তাররা অনলাইনে রোগী দেখছেন। সবাই সব করছেন। শুধু কাজ হচ্ছে না অভিনয় জগতের। সব টিভিতেই এখন রিপিট প্রোগ্রাম হচ্ছে, পুরনো নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে।

এভাবেই পার করেছি আমরা বাংলা নববর্ষ। হয়তো আসন্ন ঈদও আমরা এভাবে পার করব পুরনো সব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দেখে। অথচ এখন এই সময়ে কত কাজ হওয়ার কথা ছিল। কত ব্যস্ত থাকে ঈদের এ সময়টা। এটাই তো ছিল কাজের সবচেয়ে বড় একটা মৌসুম।

একদিন হয়তো এই ঝড় থেমে যাবে। মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। সবাই আবার ফিরে যাবে কাজে। আবার কাজ শুরু হবে এই রুপালি শোবিজে। লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশনে মুখরিত হবে শুটিং পাড়া। কিন্তু যে শূন্যতা, অনিশ্চয়তা আর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এই শোবিজে গত দুই মাস ধরে, তা কি আমরা সবাই কাটিয়ে উঠতে পারব?

কেউই কিন্তু জানি না, আর কতদিন আমরা এভাবে থেমে থাকব। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এত বড় একটা ক্ষেত্র, তারপরও নেই কোনো সরকারি সহায়তা বা প্রণোদনা। আবার জীবন শুরু হোক জীবনের নিয়মে। হাসি, আনন্দ আর কোলাহলে। লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশনে।